At Monday, November 24, 2025
আল কুরআনের আলোকে মহাবিশ্ব ও গ্যালাক্সি

পবিত্র আল কুরআনে মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির বা নক্ষত্রমন্ডলীর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার উল্লেখ নেই। কুরআন মূলত মানবজাতির হেদায়েত বা পথপ্রদর্শনের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে, এটি কোনো বিজ্ঞানের পরিসংখ্যানমূলক গ্রন্থ নয়। তবে কুরআনের ব্যাখ্যা ও আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করলে মহাবিশ্বের বিশালতা এবং গঠন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কিছু মূল পয়েন্ট নিচে তুলে ধরা হলো:

১. সাত আসমান (Sab'a Samawat) ও গ্যালাক্সির অবস্থান

কুরআনে বহুবার ‘সাত আসমান’ বা সপ্তাকাশের কথা বলা হয়েছে। অনেক মুফাসসির এবং ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, আমরা আধুনিক টেলিস্কোপ বা বিজ্ঞানের মাধ্যমে মহাবিশ্বের যতদূর পর্যন্ত (কোটি কোটি গ্যালাক্সি) দেখতে পাই, তার সবই প্রথম আসমান বা ‘দুনিয়ার আকাশ’-এর অন্তর্ভুক্ত।

দলিল: সূরা আল-মুলক, আয়াত ৫-এ আল্লাহ বলেন:

"আমি নিকটবর্তী আসমানকে প্রদীপপুঞ্জ (নক্ষত্ররাজি) দ্বারা সুশোভিত করেছি..."

যেহেতু নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলো ‘প্রদীপ’ বা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে, তাই কুরআনের ভাষ্যমতে এই বিশাল মহাবিশ্বের দৃশ্যমান সব গ্যালাক্সিই ‘প্রথম আসমানের’ অংশ হতে পারে। বাকি ছয়টি আসমান এর বাইরে এবং আমাদের কল্পনারও অতীত।

২. মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ (Expansion of the Universe)

কুরআন মহাবিশ্বের নির্দিষ্ট সংখ্যা না বললেও এর বিশালতা ও ক্রমাগত বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছে, যা আধুনিক বিজ্ঞানের (Big Bang ও Cosmic Expansion) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দলিল: সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ৪৭-এ বলা হয়েছে:

"আমি নিজ ক্ষমতা বলে আকাশ (মহাবিশ্ব) নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সম্প্রসারিত করছি।"

এর অর্থ হলো, মহাবিশ্বের সীমানা এবং এর মধ্যকার বস্তুর সংখ্যা (যেমন গ্যালাক্সি) স্থির নয়, বরং এটি অকল্পনীয়ভাবে বিশাল এবং স্রষ্টার ইচ্ছায় প্রসারিত হচ্ছে।

৩. অসংখ্য ও অগণিত সৃষ্টি

কুরআনে নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ না থাকার একটি হেকমত বা প্রজ্ঞা হলো—আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতা মানুষের গণনার ক্ষমতার বাইরে। সূরা আল-কাহফ, আয়াত ১০৯-এ বলা হয়েছে, আল্লাহর কথা বা সৃষ্টি লিখে শেষ করার মতো কালি সাগরের জলেও হবে না। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রের সংখ্যা মানুষের গণনার ঊর্ধ্বে হতে পারে।


সারসংক্ষেপ

আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আনুমানিক ২০০ বিলিয়ন (২০ হাজার কোটি) থেকে ২ ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি থাকতে পারে। আল কুরআন এই নির্দিষ্ট সংখ্যাটি বলেনি, তবে এটি স্পষ্ট করেছে যে:

  • এই মহাবিশ্ব সুশৃঙ্খল ও বিশাল।
  • দৃশ্যমান সবকিছুই কেবল ‘নিকটবর্তী আসমানের’ অংশ।
  • মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে।

কুরআনিক সৃষ্টিতত্ত্ব: বিস্তারিত আলোচনা

আল কুরআনের আলোকে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব, গঠন এবং এর পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিচে আলোচনা করা হলো। কুরআনে মহাবিশ্ব বা 'আল-কাউন' সম্পর্কে যেসব আয়াত এসেছে, তা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান (Astronomy) এবং সৃষ্টিতত্ত্বের (Cosmology) অনেক ধারণার সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।

১. মহাবিশ্বের উৎপত্তি: এক বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণ (Big Bang)

আধুনিক বিজ্ঞান বলে, মহাবিশ্ব শুরুতে একটি অতি ক্ষুদ্র ও ঘন বিন্দু (Singularity) ছিল, যা পরে বিস্ফোরিত হয়ে আলাদা হয়ে যায়। কুরআনে ১৪০০ বছর আগে ঠিক এই ধারণাই দেওয়া হয়েছে।

  • আয়াত: সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৩০
    "অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল (Ratqan); অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম (Fataqnahuma)..."
  • ব্যাখ্যা: আরবি শব্দ 'রাতক' অর্থ হলো মিশে থাকা বা সেলাই করা এবং 'ফাতক' অর্থ ছিঁড়ে আলাদা করা বা বিদীর্ণ করা। এটি মহাবিশ্বের সৃষ্টির শুরুর মুহূর্তের দিকে ইঙ্গিত করে।

২. ধোঁয়া বা গ্যাসীয় অবস্থা (Gaseous Mass)

নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি সৃষ্টির আগে মহাবিশ্ব ধোঁয়া বা গ্যাসের কুণ্ডলী ছিল। বিজ্ঞানের ভাষায় একে 'Nebula' বা নীহারিকা বলা যেতে পারে।

  • আয়াত: সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ১১
    "অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বা ধোঁয়া (Dukhan)। তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, 'তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়'..."
  • ব্যাখ্যা: এখানে 'দুখান' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ ধোঁয়া বা উত্তপ্ত গ্যাস। বিজ্ঞান নিশ্চিত করেছে যে, গ্যালাক্সি তৈরি হওয়ার আগে মহাবিশ্ব মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের সমষ্টি ছিল।

৩. সাত আসমান এবং তাদের স্তরবিন্যাস

কুরআনে মহাবিশ্বকে 'সাত আসমান' (Sab'a Samawat) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর গঠন কেমন হতে পারে, তা নিয়ে মুফাসসির ও বিজ্ঞানমনস্ক মুসলিমদের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

  • প্রথম আসমান (সামাউদ-দুনিয়া): সূরা আল-মুলক (আয়াত ৫) ও সূরা আস-সাফফাত (আয়াত ৬)-এ বলা হয়েছে, আল্লাহ ‘নিকটবর্তী আসমানকে’ নক্ষত্ররাজি দ্বারা সাজিয়েছেন।
    তাৎপর্য: এর অর্থ হলো, আমরা টেলিস্কোপ দিয়ে যতদূর দেখতে পাই (আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, অন্যান্য গ্যালাক্সি, কোয়াসার, ব্ল্যাক হোল)—এই সবকিছুই প্রথম আসমানের অন্তর্গত।
  • বাকি ছয় আসমান: বাকি ছয়টি আসমান প্রথম আসমানের বাইরে অবস্থিত। আধুনিক বিজ্ঞানের 'মাল্টিভার্স' (Multiverse) বা 'প্যারালাল ইউনিভার্স' অথবা 'উচ্চতর ডাইমেনশন'-এর ধারণা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।

৪. মহাবিশ্বের ক্রমবিকাশ (৬ দিনে সৃষ্টি)

কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ মহাবিশ্বকে 'ছয় দিনে' (Sittati Ayyam) সৃষ্টি করেছেন।

  • আয়াত: সূরা আল-আরাফ, আয়াত ৫৪।
  • ব্যাখ্যা: আরবি ভাষায় 'আইয়াম' (Ayyam) শব্দের অর্থ কেবল ২৪ ঘণ্টার দিন নয়, বরং এটি 'দীর্ঘ সময়কাল', 'যুগ' বা 'পর্যায়' (Aeons/Periods) বোঝায়। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব এক মুহূর্তেই তৈরি হয়নি, বরং এটি ছয়টি দীর্ঘ ধাপে বা পর্যায়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে।

৫. মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ (Expanding Universe)

১৯২৯ সালে এডুইন হাবল আবিষ্কার করেন যে মহাবিশ্ব স্থির নয়, বরং এটি বেলুনের মতো ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে।

  • আয়াত: সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত ৪৭
    "আমি নিজ ক্ষমতা বলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সম্প্রসারিত করছি।"
  • তাৎপর্য: কুরআনে 'মুসিউন' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ 'যিনি ক্রমাগত প্রশস্ত বা প্রসারিত করছেন'। এটি আধুনিক কসমোলজির অন্যতম ভিত্তি।

৬. মহাবিশ্বের পরিণতি: দ্য বিগ ক্রাঞ্চ (The Big Crunch)

বিজ্ঞানের একটি থিওরি হলো, মহাবিশ্ব যেমন প্রসারিত হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটি আবার সংকুচিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কুরআনও এমন একটি পরিণতির কথা বলে।

  • আয়াত: সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ১০৪
    "সেদিন আমি আকাশমণ্ডলীকে গুটিয়ে নেব, যেভাবে লিখিত কাগজপত্র গুটিয়ে রাখা হয়। যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবেই এর পুনরাবৃত্তি করব..."
  • ব্যাখ্যা: অর্থাৎ মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ার পর আবার গুটিয়ে এনে আগের অবস্থায় (Singularity-তে) ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

এক নজরে কুরআনিক কসমোলজি

বিষয় কুরআনের ধারণা আধুনিক বিজ্ঞান
সূচনা ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল (রাতক) বিগ ব্যাং (Singularity)
প্রাথমিক অবস্থা ধোঁয়া (দুখান) গ্যাসীয় নেবুলা
দৃশ্যমান জগত প্রথম আসমান (নক্ষত্রমণ্ডিত) অবজারভেবল ইউনিভার্স
গতিশীলতা ক্রমাগত সম্প্রসারণ এক্সপান্ডিং ইউনিভার্স
সমাপ্তি গুটিয়ে নেওয়া (লিখিত কাগজের মতো) বিগ ক্রাঞ্চ / কলাপস